সরকার, গোয়েন্দা সংস্থা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সাইবার নিরাপত্তা কর্মী বা পেনটেস্টার সবাই ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে। কিন্তু এই ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স কী? অনেক দিন যাবৎ ভাবছিলাম এই বিষয়ে লিখবো কিন্তু ব্যস্ততার কারণে লিখা হচ্ছিল না। অবশেষে লেখা শুরু করে দিলাম। আসলে ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স এত বড় একটা বিষয়ে যে কোনো একজনের একার পক্ষে সব লেখা সম্ভব নয়, এমনকি কারো একার পক্ষে সব জানাটাই কঠিন। আমিও সব জানি না। তবে যেটুকু জানি তা থেকে খানিক লেখার চেষ্টা করছি। এই ব্লগটিতে শুধু ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স জিনিসটা কী তা লিখেছি। যারা ওসিন্ট বিষয়ে কিছুই জানে না তাদের জন্য এই ব্লগটা। ওসিন্ট বিষয়ে আরও লেখার ইচ্ছা আমার আছে। সেইসব ব্লগে কীভাবে ওসিন্ট ব্যবহার করে কোনো উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা যায় এবং এজন্য কী কী টুলস ও টেকনিক ব্যবহার করা যেতে পারে সে বিষয়ে লেখার চেষ্টা করবো।

ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স

ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স (Open Source Intelligence - OSINT) বলতে কোনো উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উন্মুক্ত উৎস যেমন- সংবাদপত্র, টেলিভিশন, ওয়েবসাইট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যাদি থেকে উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণকে বোঝায়। বর্তমানে সরকার, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সাইবার নিরাপত্তা কর্মী ও পেনটেস্টারসহ আরও অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স বা ওসিন্ট ব্যবহার করছে। দিন দিন যেভাবে তথ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেভাবেই ওসিন্ট-এর ব্যবহারও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স বিষয়টি ভালোভাবে বোঝার জন্য একে দুটো অংশে ভাগ করা যেতে পারে, "ওপেন সোর্স" এবং "ইন্টেলিজেন্স"। ওপেন সোর্স বলতে বোঝায় উন্মুক্ত উৎস অর্থাৎ যেসব তথ্যের-উৎস প্রায় সবাই বিনামূল্যে ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। সংবাদপত্র, রেডিও-টেলিভিশন, ব্লগ-ওয়েবসাইট, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইত্যাদি ওপেন সোর্স এর উদাহরণ। আর ইন্টেলিজেন্স হলো বিচার-বুদ্ধি ব্যবহার করে তথ্য বিশ্লেষণ ও ব্যবহার।

বিষয়টি আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য ওপেন সোর্স ইনফরমেশন বিষয়টি বোঝা যেতে পারে। ওসিন্ট বিষয়টি ওপেন সোর্স ইনফরমেশন থেকেই এসেছে। ওপেন সোর্স ইনফরমেশন হলো বিভিন্ন উৎসে বিদ্যমান তথ্য। এইসকল তথ্য publicly available অর্থাৎ সকলেই সেসব তথ্য পেতে পারে। ওপেন সোর্স ইনফরমেশন তখনই ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স হবে যখন এর সাথে বিচার-বুদ্ধি যোগ হবে। অর্থাৎ যখন কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে তথ্য বিশ্লেষণ ও ব্যবহার করা হবে।

কিছু উদাহরণ দেওয়ার চেষ্টা করি। টেলিভিশনের পর্দায় হোক আর রাস্তার ধারে হোক, প্রতিদিন আমরা অনেক বিজ্ঞাপন দেখি। সেখানে পন্য প্রস্তুতকারী কোম্পানির নাম, ঠিকানা ইত্যাদি তথ্য থাকে। এই তথ্যগুলো ওপেন সোর্স ইনফরমেশন। এইবার মনে করুন আপনার গ্রামীণফোন সিম কোম্পানির সাথে যোগাযোগের প্রয়োজন। তখন আপনি কী করবেন? আপনার অনেক বিজ্ঞাপনের ভিড়ে গ্রামীণফোনের বিজ্ঞাপনের দিকে নজর দিতে হবে। অথবা আপনি হয়তো ইন্টারনেটে গ্রামীণফোনের ওয়েবসাইটের সন্ধান করবেন। তবে শুধু ওয়েবসাইট পেলেই হবে না, সেখান থেকে যোগাযোগের তথ্য যেমন-ইমেইল ঠিকানা বা ফোন নাম্বার সংগ্রহ করতে হবে। এভাবে যখন কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করবেন, তখনই এটা ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স হবে। আবার মনে করুন আপনি কোনো একটি ওয়েবসাইটের পেনটেস্টিং করবেন। এজন্য আপনাকে হয়তো সেই ওয়েবসাইটের আইপি অ্যাড্রেস, অপারেটিং সিস্টেম, ডেটাবেজের প্রকৃতি ইত্যাদি জানতে হবে। এজন্য আপনাকে whois lookup করতে হবে বা কোনো ডোমেইন রেজিস্ট্রি দেখতে হবে। এটাও ওসিন্টের অন্তর্ভুক্ত।

ওসিন্ট মূলত ইন্টেলিজেন্সের অনেক কয়টা প্রকারের একটা। ওসিন্টের মতো আরও কিছু ইন্টেলিজেন্স টেকনিক রয়েছে। যেমন-

তবে এই সবগুলো ইন্টেলিজেন্সকে পৃথক করা কঠিন। অধিকাংশ সময় এগুলোর একাধিকটি একসাথে ব্যবহার করা হয় কোনো একটি সমস্যা সমাধান করতে।

ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স যে শুধু বর্তমানেই ব্যবহৃত হচ্ছে, তা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বা তারও আগে থেকে ওসিন্ট ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে সেসময় ওসিন্টের ব্যবহার করতো শুধু সরকার ও গোয়েন্টা সংস্থাগুলো সামরিক প্রয়োজনে। ওসিন্টকে ৩টি প্রজন্মে বিভক্ত করা হয়। এর প্রথম প্রজন্ম ২য় বিশ্বযুদ্ধ থেকে মনে করা হয়। যদিও সেসময় ইন্টারনেট ছিল না, তবে সংবাদপত্র, বই, চিঠিপত্র ইত্যাদি উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হতো এবং তা সামরিক কাজের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। ২য় প্রজন্মের শুরু হয় ইন্টারনেটের বিস্তৃতির মাধ্যমে। সাধারণ মানুষ যখন ইন্টারনেট ব্যবহার শুরু করে, তখন তথ্যের পরিমানও ব্যপকহারে বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যক্তির নিজেকে প্রকাশের সুপ্ত বাসনা পুরণের সুযোগ করে দেয়ার সাথে সাথে সবাই ব্যক্তিগত তথ্যও ইন্টারনেটে আপলোড করতে শুরু করে এবং সেইসাথে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং সাধারণ মানুষরাও ওসিন্ট ব্যবহার শুরু করে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মূলত ভোক্তাদের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞাপন দেখাতে ও বিক্রি বৃদ্ধি করতে। ওসিন্ট-এর তৃতীয় প্রজন্ম ওয়েব ৩.০ বা সিম্যান্টিক ওয়েব শুরুর সাথে শুরু হয়। সিম্যান্টিক ওয়েব হলো মেশিন লার্নিং, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইত্যাদি ব্যবহার করে উপাত্ত বিন্যাস করার যুগ। যদিও এখানে কিছু সমস্যা রয়েছে। বর্তমানে ডেটা এনক্রিপশনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সেই ডেটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা সম্ভব হচ্ছে না।

তবে বর্তমানে ওসিন্টের ব্যবহার বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কাজে ওসিন্ট ব্যবহার করছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোও অপরাধ দমনে ও অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে ওসিন্টের সাহায্য নিচ্ছে। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিশেষত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপনের কাজে ওসিন্ট ব্যবহার করে। ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করে তারা প্রত্যেকের জন্য ভিন্ন প্রোফাইল তৈরি করে পারসোনালাইজড বিজ্ঞাপন দেখাতে পারে। আবার ওয়েব কুকি ব্যবহার করে কোনো ব্যক্তির ইন্টারনেটে বিচরণ মনিটর করা হচ্ছে। ফলে কোনো ব্যক্তিকে তার পছন্দের পন্যের বিজ্ঞাপন দেখিয়ে বিক্রি বৃদ্ধি করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিভিন্ন কাজেও ওসিন্ট ব্যবহার করা হয়। সাইবার নিরাপত্তার কাজে বা পেনটেস্টিং-এ ওসিন্ট ব্যবহার করা হয়। কম্পিউটার হ্যাকিং-এর ক্ষেত্রে ওসিন্টের ব্যবহার অপরিহার্য।

ওসিন্টের ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে সাথে কিছু ঝুকিরও সৃষ্টি হয়েছে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এখন হুমকির মুখে পড়েছে। অতীতে যদি কেউ তার কোনোকিছু গোপন রাখতে চাইতো, তাহলে সে বিষয়ে অন্যদের কাছে না বলাই যথেষ্ট ছিল। যারা তাদের আলাপ-আলোচনা গোপন রাখতে চাইতো, তাদের শুধু এটা দেখতে হতো যে তাদের কথা বলার সময় বাইরের কেউ যেন উপস্থিত না থাকে। তবে বর্তমান পরিস্থিতি এরকম নয়। ইন্টারনেটে প্রতিনিয়ত ব্যক্তিগত তথ্য আপলোড হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিনিয়ত ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করছে। ফেসবুক বা টুইটার তাদের ব্যবহারকারীর নাম, পরিচয়, বয়স বৈবাহিক অবস্থা ইত্যাদি প্রায় সব তথ্যই জানে। আবার সেইসব ওয়েবসাইট বা সফটওয়্যারের বাগ ব্যবহার করে অনেক সাইবার অপরাধীরা ব্যবহারকারীর গোপন তথ্য হাতিয়ে নিচ্ছে। গুগল বা ইয়াহুর মতো সার্চ ইঞ্জিনগুলোর কারণে এখন তথ্য খুজে পাওয়া অনেক সহজ হয়েছে। এখন ইন্টারনেটে অ্যানোনিমাস বা গোপন থাকা প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। যদি কেউ ইন্টারনেট ব্যবহার নাও করে, তবুও দেখা যায় তার তথ্য ইন্টারনেটে পাওয়া যাচ্ছে --- তার বন্ধু-বান্ধব বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা অফিস থেকে হয়তো সেই তথ্য ইন্টারনেটে আপলোড করা হচ্ছে। ফলে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বজায় থাকছে না। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান গোপন তথ্য সংগ্রহ করে তা অন্যদের কাছে বিক্রি করছে। সাইবার অপরাধীরা সেই তথ্য কিনে নেয় নিজেদের ফেইক প্রোফাইল তৈরির কাজে। তারা অন্য ব্যক্তি সেজে অপরাধ করে নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে ফেলে, ফলে সাজা ভোগ করতে হয় নিরপরাধ ব্যক্তিকে। আবার সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়াররাও এসব ব্যক্তিগত তথ্য কিনে নেয় বা নিজেরা সংগ্রহ করে সফল আক্রমণ পরিচালনা করতে। ফলে জীবনের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে।

আবার তথ্যের বৃদ্ধির সাথে সাথে মিথ্যা বা ভুল তথ্যের পরিমানও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ওসিন্টের জন্য সংগৃহীত তথ্যের সত্যতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো যে তথ্যের ভিত্তিতে কাজ করবে সেই তথ্য ভুল হলে অপরাধ দমন করা ও অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা কঠিন এবং অনেক সময় প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। আর ইন্টারনেটে ভুল তথ্য আপলোড করা বিশেষ কোনো ব্যাপার নয়। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেইক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে যেখানে ভূয়া নাম ও তথ্য দেয়া হয়। ফলে ওসিন্টের ব্যবহারও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।

ওসিন্ট সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে ব্যবহার করা হচ্ছে। বর্তমান সময়ে ওসিন্ট গোয়েন্দা সংস্থা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সাইবার নিরাপত্তা কর্মীদের নিকট অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ। তবে মানবাধিকারের প্রশ্নে ওসিন্টকে গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা উচিত। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যেমন ওসিন্ট ব্যবহার করছে অপরাধ দমনে, তেমনই অপরাধীরা ওসিন্ট ব্যবহার করছে আরও সফল আক্রমণ পরিচালনা করতে। ওসিন্টের ভালো ও খারাপ উভয় দিকই রয়েছে এবং এভাবেই ওসিন্টের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। তাই ওসিন্টের ভবিষ্যৎ রূপ কী হবে তা এখনই বলা সম্ভব নয়।